‘সবার খাতা দেয়া হলেও আমার খাতা দেয়নি। এরপর আমার মুখ চেপে জোর করে মাটির উপর নিয়ে যায়। সেখানে গুরু ছিল। গুরু ব্যাগ থেকে টেপ বের করে আমার মুখ আটকে দেয়। একটা সিরিঞ্জ বের করে পা থেকে রক্ত বের করে নেয়। কাউকে না বলার জন্য গলায় চাকু ধরে স্যার আর বলে, ‘কাউকে বললে তোকে মেরে ফেলব’।
এভাবেই স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও উপস্থিত অভিভাবকদের সামনে নিজের উপর করা লোমহর্ষক অত্যাচারের বর্ণনা দিচ্ছিল নাটোরের মরিয়ম স্কুলের কেজি-২ এর ছাত্রী সাবিহা সাবরীন। সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়িয়ার সাব্বির হোসেন ও আশরাফী খাতুনের ছয় বছরের শিশু ওই স্কুলের ‘ভুয়া শিক্ষক’ শ্রী আশিস সরকার (২৭) লালসার শিকার হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে ও বাইরে বিভিন্ন সময় শিশু সাবিহাকে ডেকে নিয়ে শরীরের বিভিন্নস্থানে হাত দিয়ে লালসা চরিতার্থ করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে গত মাসে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন শিশুটির মা। এ বিষয়ে নাটোরের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়া স্কুল কর্তৃপক্ষ ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে।
এদিকে ঘটনার পর থেকে ওই শিক্ষক পলাতক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কেউই শিক্ষক আশিসের খোঁজ দিতে পারেন নি। তবে জানা গেছে, সামনা সামনি না এলেও আশিস প্রধান শিক্ষিকা নিভা গোমেজসহ মিতা সাহা ও সালমা খাতুন নামের তিন জন শিক্ষিকার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
এ ব্যাপারে শনিবার সকালে শিক্ষক-অভিভাবক-ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শিশুটির মা আশরাফী খাতুন অভিযোগ করেন, শিক্ষক আশিস তার শিশুকন্যার সাথে যেমন আচরণ করত তা শিক্ষক-ছাত্রীসুলভ নয়। তার আচরণে অন্য ইঙ্গিত থাকতো। কিছুদিন আগে স্কুলের টিফিন প্রিয়ডে সাবিহাকে জোরপূর্ক শ্রেণিকক্ষ থেকে তুলে নেয় আশিস। তাকে স্কুলের এক কোনে ডেকে নিয়ে মুখ আটকে সিরিঞ্জে করে রক্ত নেয় সে। এ সময় সাবিহা চিৎকার করলে তার সহপাঠীরা এগিয়ে আসে এবং তাকে ছেড়ে দেয় আশিস। এ সময় সাবিহার বাম হাতের একটি আঙ্গুল কেটেও জখম করে।
গত ১২ই মে সকালে সাবিহাকে ডেকে স্কুলের টয়লেটের সামনে নিয়ে আসে। সে সময় গুরু নামে এক লোকও স্কুলে প্রবেশ করে। সেদিনের ঘটনা কাউকে বললে সাবিহাকে ড্রেনে ফেলে দেয়ার ও হুমকি দেয় সময় আশিসের সাথে থাকা গুরু নামে একজন লোকের বস্তা থেকে ড্রিল মেশিন বের করে পেটে ঠেঁকিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
সাবিহার বাবা সাব্বির হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার মেয়েকে হত্যার উদ্দেশ্যে গলায় ছুরি ধরেছিল শিক্ষক আশিস। একটি শিশুর সাথে এমন ঘটনা ঘটার পরও স্কুল কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ঘটনার দুদিন পর প্রধান শিক্ষিকাকে জানালে তিনি ঢাকা যাবার কথা বলে চলে যান। তিনিও বিষয়টি কর্ণপাত করেননি। এমন নৃশংসতায় জড়িত শিক্ষকের দ্রুত শাস্তির দাবি করছি। সেই সাথে তাকে অপসারণ করারও দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে অভিযুক্ত শিক্ষককে বাঁচাতে বিভিন্ন উপায়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। শনিবার সকালে ওই স্কুলে গিয়ে শিক্ষক আশিসের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষিকা নিভা গোমেজ প্রথমে আশিস সম্পর্কে জানেন না বলে সাংবাদিকদের জানান। প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকতা করেন অথচ তার সম্পর্কে জানেন না কেন জানতে চাইলে হকচকিয়ে যান প্রধান শিক্ষিকা। তিনি কিছুক্ষণ পর একটি কাগজে আশিসের নাম ঠিকানা এনে দিলেও কোন ছবি দেখাকে পারেননি আশিষের।
যে শিক্ষকের রিরুদ্ধে এতবড় অভিযোগ, প্রথমে তাকে হাজির না করা এবং পরে তার কোন তথ্য নেই প্রধান শিক্ষিকার এমন দাবির পর উপস্থিত অভিভাবকরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলে প্রধান শিক্ষিকা আশিষের একটি জীবন বৃত্তান্ত এনে সাংবাদিকদের দেখান। ওই জীবন বৃত্তান্তে আশিসের কোন স্বাক্ষর নেই। সেখানে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বরও ভুয়া। তবে আশিষের ঠিকানা দেয়া আছে বঙ্গজ্বল নাটোর। তার পিতার নাম অশ্বিনী সরকার। সে ২০০৯ সালে এসএসসি ও ২০১১ সালে এইচ এসসি পাশ করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নাটোরের এন এস সরকারি কলেজ থেকে ২০১৫ সালে বিএ অনার্স পাশ করে।
শিক্ষকের স্বাক্ষরবিহীন জীবন বৃত্তান্ত জমা নিয়ে কিভাবে তাকে পড়ানোর সুযোগ দেয়া হল- জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষিকা নিভা রানী কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
তবে তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানটি খ্রিষ্টান রীতিতে পরিচালিত হওয়ায় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ফাদার বিকার রিবেরু। এখানে আগত শিক্ষকদের কয়েকমাস শিক্ষানবীশ শিক্ষক হিসেবে রেখে পরে চুড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়। সেভাবেই শিক্ষক আশিস এখানে পাঠদান করছিলেন।
কিভাবে আশিস প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকতা শুরু করেন জানতে কথা হয় কয়েকজন শিক্ষক ও অভিভাবদের সাথে। তারা জানান, অভিযুক্ত আশিসকে পড়ানোর সুযোগ দিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে স্কুলে আনেন আরেক শিক্ষিকা মিতা রাণী সাহা। তারা শহরের বঙ্গজ্বল চাঁইপাড়ায় পাশাপাশি বাস করেন। শিক্ষিকা মিতাও এই ঘটনায় জড়িত আছেন বলে দাবি অভিভাবকদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক জানান, গত ২৮ শে মে অভিযুক্ত শিক্ষক আশিস স্কুলে আসে এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বলে শুনে যায়।
আনীত অভিযোগের ব্যাপারে আশিসের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনেও যোগাযোগ করা হলে সেটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
আশিসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত একই স্কুলের শিক্ষক মিতা সাহার সাথে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আশিসের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ মিথ্যা। আশিস ভালো ছেলে ও ষড়যন্ত্রের শিকার। আশিসের বিরুদ্ধে শিশু সাবিহা ও অভিভাবকদের অভিযোগের নেপথ্যে অন্যকিছু থাকতে পারে’।
স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রতিষ্ঠারটি শুরু থেকেই আশিসের বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাকেও জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। ভুক্তভোগী ও অভিভাবকরা আমাকে জানায় বিষয়টি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শিক্ষক আশিসের শাস্তি ও অপসারণ দাবি করছি।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন জানান, এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি দেখার জন্য একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অভিযুক্ত শিক্ষক আশিসের দ্রুত অপসারণ ও বিচার দাবি করেছেন অভিভাবকরা।